17 Nov 2024, 06:11 pm

মুনতাহিরের মন ভাল নেই   — এম এ কবীর (সাংবাদিক)

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

মুনতাহিরের মন ভাল নেই। রাজধানীর ভাষা প্রদীপ উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সে। খুব বেশি পরিচিতি নেই বিদ্যালয়টির। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই স্কুল সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়েছেন অনেকেই। কারণ মুনতাহিরের একটি আবেদন নতুন করে ভাবিয়েছে অনেককেই । গত ৩ নভেম্বর-২০২২। স্কুলে উপস্থিত হতে পারেনি সে। নিয়ম অনুযায়ী স্কুলে উপস্থিত না হলে প্রধান শিক্ষক বরাবর ছুটির আবেদন করতে হয়। ৬ নভেম্বর মুনতাহির প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত আবেদনপত্রে তার স্কুলে উপস্থিত না থাকার যে কারণ উল্লেখ করেছে সেটিই আলোচনার বিষয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া মুনতাহিরের আবেদনপত্রটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মুনতাহির লিখেছে, ‘জনাব, বিনীত নিবেদন এই যে, আমি আপনার বিদ্যালয়ের চতুর্থ  শ্রেণির একজন নিয়মিত ছাত্র। আমার মন খারাপ থাকার কারণে আমি গত ৩-১১-২০২২ তারিখে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে পারিনি। অতএব বিনীত প্রার্থনা এই যে, আমাকে উক্ত একদিনের ছুটি মঞ্জুর করে বাধিত করবেন।’

হতে পারে এ ধরনের আবেদন এই প্রথম। কিংবা এই ‘মন খারাপ’ কারণ আবেদনে উল্লেখ করা হলেও সেটি নিয়ে হাসি-তামাসা করে সেখানেই ফেলে দেয়া হয়েছে। কিংবা মুনতাহিরকে এ রকম কারণ লেখার জন্য বকা দেয়া হয়েছে। যে কোনো কিছুই হতে পারে, কারণ এ ধরনের আবেদনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতার কথা লেখার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একজন শিক্ষার্থীকে শেখানো হয় এবং এটিই ছুটি মঞ্জুরের একমাত্র গ্রহণযোগ্য কারণ হিসেবে দীর্ঘদিন প্রচলিত আছে। এই চর্চার বিপরীতে গিয়ে মুনতাহির এত ছোট বয়সে নিজের মনের অবস্থাকে চিনতে পেরেছে এবং সেটি প্রকাশ করতে পেরেছে সেটিই ভানার বিষয়। এই আবেদন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ট্রল হয়েছে। এই ট্রলের পেছনেও হয়তো কাজ করেছে আমাদের এতদিন মন খারাপের আবেদন দেখার অনভ্যস্ততা। অনেকে এই বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন, এখন এই মন খারাপের অজুহাত দিয়ে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসতে চাইবে না। আবার কেউ কেউ বলেছেন ছোটদের আবার মন কী? এই মনে হলো আবার একটু পরেই ভুলে যাবে। ওরা তো প্রাপ্তবয়স্ক নয়। এদের যখন যা মনে হয় তাই বলে। এটাকে তো আর মন খারাপ বা মানসিক স্বাস্থ্য হিসেবে ধরে নেয়া যাবে না। এদের মন খারাপের গুরুত্ব দিলে তো আর কিছু করা যাবে না।’ তবে যাই বলা হোক সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যে বিষয়টিতে নজর দেয়া দরকার তা হলো মানসিক স্বাস্থ্য। অনেকে মনে করেন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি শুধু ‘বড়’দেরই থাকবে। শিশু মানসিক স্বাস্থ্যের কী বোঝে?

ধরা যাক শিশুটি বলেছে, ‘আমি যে জামা পরতে চাই, মা সেটি পরতে দেয় না, আমার খুব মন খারাপ হয়। আমি যখন ঘুমাতে চাইনা খেলতে চাই, মা জোর করে আমাকে ঘুমাতে বলে। তখনো আমার অনেক মন খারাপ হয়।’ আমরা শিশুদের রাগ, জিদ, কান্না যতটা আমলে নিই, ঠিক ততটাই অমনোযোগিতা দেখাই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে, কারণ আমরা শিশুদের মন খারাপের বিষয়টি নিয়ে চিন্তাও করি না। শিশুদের শারীরিক সমস্যা নিয়ে আমরা বিচলিত হই, মনের দিক থেকে একজন শিশু কেমন বোধ করছে কিংবা আদৌ ভালো আছে কিনা সেটির খোঁজখবর আমরা নিই না। সেজন্যই চতুর্থ  শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন শিশুর মন খারাপ করে ¯ু‹লে না যাওয়াকে আমরা তার মানসিক অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন না করে শিশুসুলভ আবেগ, মজা ও হাস্যকর বিষয় হিসেবে পাঠ করতে চাই।

সুইস সাইকোলজিস্ট জা পিয়াজের মতে, একটি শিশু জন্মের পর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মানসিক বিকাশের বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে যায় এবং একটি ধাপ পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার পরেই কেবল সে পরবর্তী ধাপে প্রবেশ করতে পারে। পিয়াজের মতে, মানসিক বিকাশের প্রাথমিক স্তরটি গঠিত হয় কিছু সুনির্দিষ্ট মানসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়া হচ্ছে অনেকটা কম্পিউটার সফটওয়্যারের মত, যার মাধ্যমে একজন মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাবলী (কম্পিউটারের ডেটা স্বরূপ) ধারন, বিশ্লেষণ এবং সেই অনুযায়ী পরিচালনা করতে পারে। পিয়াজের তত্ত্ব অনুসারে তা বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন স্তর পার হয়ে অবশেষে পূর্ণ মানসিক পরিপক্কতা পায়। এবং প্রতিটি স্তরে তাদের মানসিক প্রক্রিয়ার কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংযোজন ঘটে, পিয়াজে যার নাম দিয়েছেন অ্যাসিমিলেশন এবং অ্যাকোমোডেশন। অ্যাসিমিলেশন হচ্ছে ইতোমধ্যে বিদ্যমান স্কিমার সাহায্যে কর্ম সম্পাদন। যে বাচ্চাটা বল নিয়ে মুখে পুরল, সেখানে সে তার বিদ্যমান স্কিমাকে (মাতৃদুগ্ধ পান) কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করল। আবার আরেকটি বাচ্চা হয়তো চিড়িয়াখানায় উড়ন্ত কাঠবিড়ালিকে ‘পাখি’ বলে চিহ্নিত করল। কারণ তার মনের মধ্যে পাখির একটি স্কিমা রয়েছে এরকম যে ‘যা উড়তে পারে সেটাই পাখি’। অন্যদিকে অ্যাকোমোডেশন হচ্ছে বিদ্যমান স্কিমার কিছুটা পরিবর্তন বা সংযোজন অথবা সম্পূর্ণ নতুন কোন স্কিমা তৈরিকরণ। আমরা যখন কোন নতুন কম্পিউটার কিনি তখন অনেক সফটওয়্যার তার মধ্যে অলরেডি ইন্সটল্ড থাকে। পরবর্তীতে সেসব সফটওয়্যারের সাহায্যে আমরা সরাসরি কিছু কাজ করতে পারি, আবার কোনো কোনো সময় কাজ করতে গেলে সফটওয়্যার আপডেট করা লাগে। প্রশ্ন হতে পারে জা পিয়াজের এত কঠিন কঠিন তত্ত্ব জেনে কী লাভ?  তার আগে জানা দরকার, বাবা-মা বাচ্চাদের ফিজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে কমবেশি অবগত। কোন বয়সে বাচ্চার দাঁত ওঠে, বাচ্চা কখন বসবে, কখন দাঁড়াবে এগুলো সম্পর্কে সচেতন। তারা বাচ্চার শারীরিক বিকাশ সম্পর্কে যত বেশি জানে, ঠিক ততটাই কম জানে বাচ্চার মানসিক বিকাশ সম্পর্কে।

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ রূপকার। আজকের শিশুর হাতেই ন্যস্ত হবে আগামীর নেতৃত্ব। তারাই ভবিষ্যতে বিশ^ পরিচালনা করবে, সভ্যতা-সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেবে। শিশু মানেই নিষ্পাপ ঝলমলে মুখ, মায়াময় আকর্ষণ অপার সম্ভাবনা। প্রতিটি শিশুর মধ্যেই লুকায়িত থাকে সুপ্ত প্রতিভা। সেই প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। আর জাগিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হয় আগামীদিন। আজকের শিশুই আগামী দিনের পরিণত মানুষ। তারাই বড়দের স্বপ্নের উত্তরাধিকার, জাতির কর্ণধার। তারাই একদিন হবে শিক্ষক, অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক, সেনাপতি, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ কিংবা শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক। শিশু শুধু পিতা মাতার আরাধনার ধন নয়, তারা দেশ ও জাতির সম্পদ, শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ নিশ্চিত হলে দেশ ও জাতির উপর পড়ে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব। তাই এ অনন্ত সম্ভাবনাময় সম্পদকে রক্ষা করা, সুন্দর ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করার বিষয়টি অধিকতর জরুরি।

ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন-‘শিশুরাই জাতির পিতা।’একজন যোগ্য পিতা ব্যতিত যেমন একটি পরিবার কল্পনা করা যায় না তেমনি শিশুদের বিকাশ ও তাদের অধিকার বাস্তবায়ন ব্যতীত গোটা পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধে, বিজ্ঞান মনস্কতায়, ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। কবির ভাষায় ‘ মানব কোলে জন্মে কি সবাই মানুষ হয়/ আদর্শ মানুষ জন্ম দেয় আমাদের বিদ্যালয়।’

একটা সময় যখন বিকেল হলেই শিশুরা চলে যেত বাড়ির পাশের মাঠে। ক্রিকেট, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, ফুটবলসহ নানারকম খেলায় মত্ত থাকত তারা। সময়ের ব্যবধানে মাঠের অভাবে শিশুরা খেলছে বাড়ির গ্যারেজে কিংবা রাস্তার গলিতে। যার কারণে তাদের দিন কাটে এখন কম্পিউটার আর স্মার্টফোনে গেম খেলে। ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত শৈশব, তারুণ্যের উদ্যম। চারদিকে বহুতল ভবন, শপিংমল, ডিজিটাল পার্ক, নির্মাণ হচ্ছে ইটভাটা তাতে দখল হয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। তথ্যপ্রযুক্তির মহাপ্লাবনে ডিজিটাল ডিভাইসমুখী হয়ে উঠেছে শিশু,কিশোর,তরুণ,যুবক। কনটেন্ট দেখেই পার করছে মূল্যবান সময়।

আমাদের বয়সের বিভিন্ন স্তরেই মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিত। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কথাবার্তা বলতে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। এটিকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দেখা যায়, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের, বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুর, আত্মীয়ের সঙ্গে আত্মীয়ের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। ‘মন ভালো নেই কিংবা মানসিকভাবে ভালো বোধ করছি না’ এই বাক্যকে আমরা খুব বেশি আমলে নিই না। এই আমলে না নেয়া কারও কারও জীবন পরিসমাপ্তির দিকেও নিয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করা শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাদের বাবা-মাকে জানাতে দিচ্ছে না। এমনকি দু-একজন বলেছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ তাই তারা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত। কেউ কাউকে বোঝার চেষ্টা করছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন আবাসিক হলে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়া হলেও তথ্য বলছে শিক্ষার্থীরা মনোবিজ্ঞানীদের কাছে খুবই কম যান। কারণ লোকলজ্জা এবং ‘আমার সমস্যা অন্যকে বলে কী লাভ’ এই মনস্কতা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সমর্থন না পাওয়ার পাশাপাশি তার বিষয়ে কানাকানি, হাসাহাসি অথবা অন্যের ‘গসিপ’-এর পাঠ হয়ে যায়। সেগুলোকেও ভয় পায় অনেকেই।

আমরা মন খারাপের কারণও অন্যের কাছে বেশিরভাগ সময়ই বলতে চাই না। আমাদের একে অন্যের প্রতি অবহেলা, হেয় করার মনস্কতা, কটাক্ষ করা, অসম্মান, ঘৃণা সবই হতে পারে আরেকজনের মন খারাপের কারণ। এ ক্ষেত্রে ব্যথার আর্তনাদ হয়তো আপনি শুনবেন না, কোনো রক্তপাত হয়তো দেখবেন না কিন্তু বুঝতেও পারবেন না এই মানসিক খারাপ লাগা তাকে কীভাবে কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে। আমরা সেসব ক্ষেত্রে মনে করি, এটি ‘এমনি এমনি’ ঠিক হয়ে যাবে কিংবা সময়েই সব ভুলে যাবে। সবার ক্ষেত্রে একইরকম হয় না। কারও কারও ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়ার বিপরীতে সংকট আরও গভীর হয়। তাই কারও ঘটনা দিয়ে অন্যকে বিচার করা যাবে না।

প্রকাশিত: দৈনিক সংবাদ- ২০/১১/২০২২ইং অনলাইন, প্রিন্ট কাগজ- ২১/ ১১/২০২২ইং, দৈনিক জনতা : ২৩/১১/ ২০২২ইং।

লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঝিনাইদহ।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 2470
  • Total Visits: 1250813
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ রবিবার, ১৭ই নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ১৫ই জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, সন্ধ্যা ৬:১১

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
18192021222324
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018